রূপালি ইলিশে আশার ঝিলিক

 হাওর বার্তা ডেস্কঃ  দারুন আশা জাগিয়েছে চকচকে রূপালী ইলিশ মাছ। বছর বছর ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে ইলিশের প্রজনন। টানা ৮ বছর ধরে প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী। মাছের রাজা ইলিশের বার্ষিক উৎপাদন এ বছর ৪ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যা চার দশকের ব্যবধানে পরিমাণে প্রায় দ্বিগুণ। যা সৃষ্টি করছে আশার ঝিলিক। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশনায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে প্রশাসনের নজরদারি, কর্মহীন সময়ে চাল বিতরণসহ গরীব জেলে-বান্ধব বিকল্প সহায়তা কর্মসূচির বাস্তবায়ন জাটকা ও মা ইলিশ নিধন রোধের ক্ষেত্রে সাফল্যের নজির সৃষ্টি করেছে। কেননা এরফলে প্রতিবছরই বাংলাদেশের নদ-নদী ও সমুদ্রসীমায় ইলিশের বংশ বিস্তার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও প্রজনন মওসুমে জাটকা ও মা ইলিশ নিধন এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ‘ডিমওয়ালা ইলিশের বিশেষ স্বাদ’ নেয়ার লোভ পরিত্যাগের ক্ষেত্রেও অধিকাংশ ক্রেতার মন-মানসিকতায় আসেনি পরিবর্তন। বর্তমানে বার্ষিক যে ৪ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদিত হচ্ছে, ভারতের মরণফাঁদ ফারাক্কা বাঁধের ধাক্কা না থাকলে পদ্মা নদীতেই আহরণ বেড়ে যেতো আরও ২ লাখ মেট্রিক টন। উৎপাদিত জাতীয় মাছ ইলিশের সরাসরি বাজার মূল্য বর্তমানে অন্তত ২২ হাজার কোটি টাকা। তবে লাখো জেলেসহ বিভিন্ন স্তরে মানুষের কর্মসংস্থান মিলিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ইলিশের অবদান প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ। ইলিশের অব্যাহত বংশবৃদ্ধি ও আহরণ বেড়ে যাওয়ার ফলে সর্বত্র প্রান্তিক জেলে পরিবারগুলো খুশী। তবে ইলিশের খাতেও একাধিক ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারসাজির কারণে দাম সাধারণ ক্রেতাদের নাগালে অর্থাৎ যৌক্তিক পর্যায়ে কখনোই নামে না। প্রকৃতির এই উদার দান যা বাংলাদেশের জন্য অনন্য এক সম্পদ সেই চকচকে রূপালী ইলিশের দিকে পড়েছে বিদেশী মাছ-লুটেরাদের লোভাতুর শ্যোন দৃষ্টি। ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনের চোরাশিকারী ও চোরাকারবারীদের মাধ্যমে ইলিশ পাচার থামেনি। এক্ষেত্রে নিবিড় তদারকি ও টহল তৎপরতা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এদিকে আগামী ২২ জুলাই শনিবার থেকে অমাবশ্যার ‘ভরা জো’র উপলক্ষকে ঘিরে বঙ্গোপসাগর উপকূল ও নদীমোহনায় ইলিশের বিচরণশীল পয়েন্টগুলোতে টনে টনে ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়বে। তবে উত্তর বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপ থাকায় সেটি কেটে না যাওয়া পর্যন্ত ইলিশ শিকারী জেলে মাঝি-মাল্লাদের কপালে চিন্তার ভাজ পড়েছে। গতকাল (সোমবার) মৎস্য বিশেষজ্ঞ, আন্তর্জাতিক সর্বশেষ গবেষণায় তথ্য-উপাত্ত সূত্র এবং সরেজমিনে চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটে জেলেদের সাথে আলাপচারিতায় বাংলাদেশের রূপালী সম্পদ ইলিশকে ঘিরে উপরোক্ত সফলতা, আশাবাদ ও সম্ভাবনার দিকগুলো ফুটে উঠেছে। অন্যদিকে আজ (মঙ্গলবার) দেশে শুরু হতে যাচ্ছে জাতীয় মৎস্য সপ্তাহ-২০১৭ইং। এবারের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘মাছ চাষে গড়বো দেশ বদলে দেব বাংলাদেশ’।
উৎপাদন ধারাবাহিক বৃদ্ধি
চার দশকের পরিসংখ্যান বলছে, দেশে ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিগত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৩ লাখ ৯৮ হাজার টন ৪শ’ মেট্রিক টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। এ বছর তা ৪ লাখ অতিক্রম করবে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ ইউনিয়নের (আইইউসিএন) গবেষণায় জানা গেছে, ১৯৮৭-৮৮ সালে বাংলাদেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ১ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন। তখন থেকে ১১ বছর যাবত ইলিশের উৎপাদন ২ থেকে আড়াই লাখ টনে সীমিত থাকে। এমনকি ২০০২-০৩ সালে উৎপাদন দেড় লাখ টনেরও নীচে নেমে আসে। জাটকা ও ডিমওয়ালা মা ইলিশ নিধনকেই এর প্রধান কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করে তা রোধকল্পে চিন্তা-ভাবনাও শুরু করেন। তখন ইলিশ রক্ষা ও উৎপাদন বাড়াতে সরকারি তোড়জোড় চলে। জাটকা ও মা মাছ ধরা বন্ধকালীন সময়ে বেকারত্ব বিবেচনায় রেখে জেলেদের মাঝে বিনামূল্যে চাল বিতরণ, নগদ সহায়তা, সচেতনতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ পরীক্ষামূলকভাবে এগিয়ে চলে। আর ধীরে ধীরে এর সুফল আসতে থাকে। এই সাফল্যের পথ ধরে উপরোক্ত সহায়তা ও প্রণোদনামূলক উদ্যোগ আরও বিস্তৃত করা হয়।
মৎস্য অধিদপ্তর এবং গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র মতে, পৃথিবীর মোট আহরিত ইলিশের ৬৫ ভাগই বাংলাদেশের। দেশের নদ-নদী, খাড়িতে আহরিত মোট মাছের ১২ শতাংশই হচ্ছে ইলিশ। বিগত ২০০০-০১ অর্থবছরে দেশে ২ লাখ ২৯ হাজার ৭১৪ টন, ২০০১-০২ সালে ২ লাখ ৯ হাজার ১২১ টন, ২০০২-০৩ সালে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৩২ টন ইলিশ উৎপাদিত হয়। এরপরই ইলিশ সংরক্ষণ বিশেষত জাটকা নিধন ও মা মাছ সুরক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বিগত ২০০৮-০৯ সাল থেকে ইলিশের উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী হতে থাকে। ২০০৮-০৯ সালে ২ লাখ ৯৮ হাজার ৯২১ টন, ২০০৯-১০ সালে ৩ লাখ ১৩ হাজার টন, ২০১০-১১ সালে ৩ লাখ ৪০ হাজার টন, ২০১২-১৩ সালে ৩ লাখ ৫১ হাজার টন, ২০১৩-১৪ সালে ৩ লাখ ৮৭ হাজার টন, ২০১৪-১৫ সালে ৩ লাখ ৮৫ হাজার এবং ২০১৫-১৬ সালে ৩ লাখ ৯৮ হাজার টন ইলিশ আহরিত হয়েছে। বিদায়ী ২০১৬-১৭ সালে ইলিশের উৎপাদন ৪ লাখ টন অতিক্রম করার কথা। সমুদ্রসম্পদ বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারতে ফারাক্কা বাঁধের গুরুতর বিরূপ প্রভাবে পদ্মায় ইলিশের উত্তম বিচরণ ও প্রজনন এলাকাগুলো গেছে হারিয়ে। স্বাধীনতা লাভের গোড়াতে পর্যন্ত দেশের প্রায় ৮০ শতাংশ ইলিশ পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, কুমার, ধলেশ্বরী, গড়াই, পায়রা, চিত্রাসহ সংলগ্ন নদনদী থেকে আহরণ করা সম্ভব ছিল। ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মাসহ অনেক নদীতে চর পড়ে ভরাট এবং নানামুখী বিপর্যয়ের কারণে অভ্যন্তরীণ নদ-নদী ও মোহনায় ইলিশের আনাগোনা কমতে কমতে প্রায় ফুরিয়ে গেছে। তবে সংরক্ষণ নীতির সাফল্যের কারণে বিভিন্ন নদ-নদী, সাগর ও উপকূলে ইলিশের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে বাড়ছে ক্রমাগত ইলিশ শিকার। বর্তমানে প্রায় ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে সাগরের বিচরণশীল এলাকাগুলোতে। যা নতুন করে আশা জাগিয়ে তুলছে।
সংরক্ষণে তাগিদ বিশেষজ্ঞদের
ইলিশের প্রজনন, বিচরণশীলতা ও পরিবেশ-প্রতিবেশ সম্পর্কে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেরিন সায়েন্সেস এন্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. হোসেন জামাল গতকাল হাওর বার্তাকে জানান, স্বাদে গন্ধে গ্রহণযোগ্যতায় রূপালী ইলিশের জুড়ি নেই। সরকার কর্তৃক জাটকা ও ডিমওয়ালা মা ইলিশ নিধন রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলেই ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেননা মা ইলিশ ঝাঁকে ঝাঁকে লোনা পানির সাগর ছেড়ে এসে নদ-নদীর মিঠাপানিতে লাখ লাখ ডিম ছেড়ে দেয়া এবং সেই ডিম পোনা থেকে সামান্য বড় জাটকা হয়ে আবারও সাগরে গিয়ে পরিপুষ্ট ও বড় হয়ে থাকে। এই দুই প্রক্রিয়া বা চেইনে বাধা দিয়ে ওদের নির্বিচরে শিকার করা হলেই ইলিশের প্রজনন ও উৎপাদন ব্যাহত হয়। এখন তা রোধ করা হচ্ছে। তবে তা আরও কড়াকড়িভাবে বন্ধ করা হলে ইলিশ জাতীয় অর্থনীতিতে এক বিশাল সম্ভাবনা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে। ইলিশের প্রাকৃতিক প্রজনন বৈশিষ্ট্যগুলো যাতে কখনোই ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। ইলিশসহ সমগ্র সামুদ্রিক সম্পদরাজিকে আল্লাহতাযালার নিয়ামত হিসেবে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ইলিশের বিচরণ পথ, প্রজনন মওসুম, সাগরে ও মিঠাপানির দিকে নিয়মমাফিক আসা-যাওয়া, পরিবেশ ইত্যাদি সুরক্ষা জরুরী। ইলিশ শিকার ও সংরক্ষণের মান্ধাতা আমলের পদ্ধতিতেও অনেক অপচয় ঘটছে জানিয়ে তিনি বলেন, এরজন্য উন্নত ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। ফিলিপাইনে সবচেয়ে সুস্বাদু ও পুষ্টিকর মাছ ‘মিল্ক ফিশ’ সুরক্ষায় দেশটি সচেতন। আমাদেরও ইলিশ সম্পদকে সুরক্ষায় আরো পদক্ষেপ নিতে হবে। মনে রাখা উচিত, আরও বিভিন্ন দেশে এমনকি ইরানের কাছে সাগর উপকূলেও কিছু ইলিশ পাওয়া যায়। কিন্তু স্বাদ ও গুণবিচারে বাংলাদেশের ইলিশের কোন তুলনা মিলে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সামুদ্রিক মৎস্য গবেষক জানান, বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকারি বৃহাদাকারের ট্রলার ভেসেলগুলো নির্বিচার মাছ শিকার ও নিধন করছে। অবিলম্বে এর নিয়ন্ত্রণ জরুরী। অনেক ট্রলার অবাধে বিশাল আকালের জাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরার পর সেখান থেকে ছোট আকারের কম দামি মাছ বিশেষত ইলিশ পোনা, জাটকা সমুদ্রেই ফেলে দিয়ে চলে আসে।
বিশিষ্ট সামুদ্রিক মৎস্য বিজ্ঞানী আলী আজম খান জানান, বঙ্গোপসাগর-উপকূলভাগে ৪শ’৭৬ প্রজাতির মাছ ও চিংড়ি আহরণ করা হয়। এরমধ্যে সর্বাপেক্ষা মূল্যবান বা অর্থকরী মৎস্য সম্পদ হচ্ছে ইলিশ (বৈজ্ঞানিক নাম: ঞবহঁধষড়ংধ রষরংযধ)। বাংলাদেশের আহরিত বা মোট উৎপাদিত মাছের মধ্যে শতকরা ১২ ভাগেরও বেশি যোগান আসে ইলিশের। জিডিপি’তে ইলিশের অবদান ১ শতাংশেরও বেশি। পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরে যে পরিমাণ ইলিশ মাছ আহরণ করা হয় এরমধ্যে ৬৫ শতাংশই উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। এরপরের অবস্থান ভারতে ১৫ শতাংশ, মিয়ানমারে ১০ শতাংশ, আরব সাগর তীরবর্তী দেশগুলো এবং প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী দেশসমূহে বাদবাকি ১০ ভাগ ইলিশ শিকার করা হয়। দেশে সাগর উপকূলভাগে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ জেলে, মাঝি-মাল্লা ইলিশ আহরণের সাথে সরাসরি জড়িত। তাছাড়া অন্তত ৫০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা ইলিশের উপর নির্ভরশীল।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর